Sunday 26 December 2021

জিন্নাহ পাকিস্তান নতুন ভাবনা

 আজ কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর জন্মদিন ।


তিনি২৫ ডিসেম্বর ১৮৭৬  সালে করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন । জিন্নাহ  ছিলেন একজন আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯১৩ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা পর্যন্ত জিন্নাহ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হন এবং আমৃত্যু এই পদে বহাল থাকেন। পাকিস্তানে তাকে কায়েদে আজম (মহান নেতা) ও বাবায়ে কওম (জাতির পিতা) হিসেবে সম্মান করা হয়। । ১৯৩০ সালে এলাহাবাদে মুসলিম লীগের অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে স্যার মুহাম্মদ ইকবাল ভারতে একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের ডাক দেন। চৌধুরী রহমত আলি ১৯৩৩ সালে একটি পুস্তিকায় সিন্ধু অববাহিকায় ও ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অন্যান্য স্থানে মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানান। ১৯৩৬ ও ১৯৩৭ সালে জিন্নাহ ও ইকবাল মতবিনিময় করেন। পরের বছরগুলোতে জিন্নাহ ইকবালের ধারণাকে গ্রহণ করেন। জিন্নাহর আশঙ্কা ছিল যে ব্রিটিশরা ভারত থেকে চলে যাওয়ার পর কংগ্রেস প্রধান আইনসভায় মুসলিমরা তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হবে।


গান্ধী না থাকলেও ভারত একদিন না একদিন স্বাধীন হতো। কিন্তু জিন্না না থাকলে পাকিস্তান কি আদৌ সম্ভব হতো ? ভারতকে স্বাধীন করার দাবীদার আরো একজন কি দু'জনের নাম শোনা যায় , কিন্তু পাকিস্তানকে স্বতন্ত্র করার দাবীদার আর একজনও নেই।  লা শরিক জিন্নাহ।  যেমন লা শরিক আল্লাহ।  ---- 

অন্নদাশংকর রায় 

ভূমিকা,

জিন্না /পাকিস্তান , নতুন ভাবনা ,

লেখকঃ শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় 

মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স 

কলকাতা


ডক্টর এবনে গোলাম সামাদ লিখেছিলেন:বর্তমান বাংলাদেশের উদ্ভব হয়েছে সাবেক পাকিস্তান ভেঙে । পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ হতে পারত না । 

(বাংলাদেশ:সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া,পৃষ্ঠা৫০)


সৌমিত্র দস্তিদার লিখেছিলেন:জিন্নাহ চেয়েছিলেন কংগ্রেস পিছিয়ে পড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা, সরকারি চাকরি ও রাজনীতিতে সামান্য কিছু জায়গা ছেড়ে দেবে। আকুল জিন্নাহ প্রশ্ন তুলেছিলেন– গরিষ্ঠ কি লঘিষ্ঠকে কিছু দিতে পারে না? বিনা যুদ্ধে যে সূচাগ্র মাটিও হিন্দুত্ববাদীরা দেবে না, জিন্নাহ তা বড় দেরিতে বুঝলেন। কংগ্রেসের প্রতি, তথাকথিত জাতীয়তাবাদীদের ওপর অনেক আস্থা ছিল জিন্নাহ-র। বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণায় কাতর জিন্নাহ দেশ ও রাজনীতি ছেড়েই চলে গেলেন বিদেশ। বহুবছর পর ফিরলেন এক্কেবারে অন‍্য জিন্নাহ হয়ে।


সমাজবিজ্ঞানের এক সাধারণ ছাত্র হিসেবে এটুকু বুঝি যে আজকের মনুবাদী রাজনীতির প্রবল দাপটের সূচনাপর্ব সেই বিশ শতকের গোড়ায়। ভারতীয় রাজনীতিতে সন্ধিক্ষণ বা ক্ষমতার বৃত্ত থেকে মুসলিম বিতাড়নের সূচনা ১৯২৮-এ। জিন্নাহ উপলক্ষ মাত্র। তাঁর ১৪ দফা প্রত‍্যাখ‍্যান একসঙ্গে অনেক বার্তা দিল দেশের জনসাধারণ ও বৃটিশ প্রভুদেরও। নিমেষে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল হিন্দু-মুসলিম ঐক‍্যের মিথ ও সম্ভাবনা। জিন্নাহর প্রস্তাবিত ১৪ দফার অন‍্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। অপরদিকে কংগ্রেস ও তার ভিতরে থাকা দক্ষিণপন্থীদের দাবি ছিল অতিকেন্দ্রায়ণ। এখন শাসকবিরোধী জোটরাজনীতির যে কেন্দ্র-রাজ‍্য সম্পর্কের পুনর্মূল‍্যায়নের স্লোগান, সেটি সর্বপ্রথম তুলেছিলেন মহম্মদ আলি জিন্নাহই। এ দাবির পিছনে নিশ্চয়ই কোনও সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি ছিল না। পাঠক, মনে রাখবেন যে ১৯২৮ সালে ধর্মীয় মেরুকরণ যখন স্পষ্ট হচ্ছে তার তিনবছর আগে ১৯২৫-এ জন্ম নিয়েছে আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ।


জন্মলগ্ন থেকেই আরএসএস ‘হিন্দু ভারত’-এর ডাক দিয়েছিল। ফলে মুসলিমদের একছটাক জমি দিতেও তারা নারাজ ছিল। কংগ্রেসের মধ্যে প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার লড়াই তখনও জারি ছিল। আজও যেমন আছে। বস্তুত ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ রদের সময় থেকে যে স্বাধীনতার সংগ্রামের সূচনা তা ক্রমেই হিন্দুত্ববাদীদের হাতে চলে গেল। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর ও আরও অন‍্যান‍্য গোষ্ঠীর বিপ্লবীদের কর্মধারা গভীরভাবে লক্ষ করলেই তা বোঝা যায়।

Friday 23 July 2021

ব্রিটিশ ভারতে গরু কোরবানির ইতিহাস খুবই করুণ ও হৃদয় বিদারক

  ব্রিটিশ ভারতে গরু কোরবানির ইতিহাস খুবই করুণ ও হৃদয় বিদারক



কোরবানি হলো আল্লাহ’র পক্ষ থেকে পরীক্ষা। আর এই পরীক্ষা হযরত আদম আ.-এর যুগ থেকেই ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। তবে তাদের পদ্ধতিটা ছিলো ভিন্ন। বর্তমান কোরবানি করা হয় নির্দিষ্ট পশু দ্বারা। এটি শুরু হয় হযরত ইবরাহিম আ.-এর যুগ থেকে। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের পর্যন্ত চলে এসেছে। কোরবানির নির্দিষ্ট পশুর একটি হলো গরু। ভারতীয় উপমহাদেশে গরু কোরবানির ইতিহাস খুবই করুণ ও হৃদয় বিদারক! বর্তমান আমরা তো অনায়েসে গরু দ্বারা কোরবানি করে ফেলি। কোনপ্রকার বাঁধা আসে না। কিন্তু এটি আমাদের পূর্বপুরুষদের পক্ষে অতটা সহজ ছিলো না। বহু কষ্টে এটি সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের অভিনবত্ব সম্ভবত একটা জায়গাতেই, গরুর মাংস। গরুর মাংসের জন্য সংগ্রাম, আন্দোলন এবং রক্ত দিতে হয়েছে, এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে কিনা সন্দেহ। বনী ইসরাইলের সামেরির পরে ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গরু হল পূর্ব বাংলার গরু। 

সিলেটের রাজা গৌড় গৌবিন্দ সম্পর্কে কম বেশি সবারই জানার কথা। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে একজন ব্যক্তি উনার শিশুপুত্রের আকিকার জন্য গরু কুরবানী করেছিলেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে গৌড় গোবিন্দ শেখ বোরহানউদ্দিনের হাত কেটে দেয় এবং শিশু পুত্রকে হত্যা করেন। বোরহানউদ্দিন বাংলার সুলতান শামসউদ্দিন  ফিরোজ শাহের কাছে গিয়ে বিচার প্রার্থনা করেন। ফিরোজ শাহ উনার ভাতিজা সিকান্দার গাজীর নেতৃত্বে একটা সেনাবাহিনী পাঠান। গৌড় গোবিন্দের শক্তিশালী বাহিনীর কাছে সিকান্দার গাজী দুইবার পরাজিত হন। তৃতীয়বার প্রধান সেনাপতি নাসিরুদ্দিনের নেতৃত্বে আবারও অভিযান প্রেরণ করা হয়। এই জিহাদে ৩৬০ জন দরবেশকে নিয়ে হযরত শাহজালাল (র.) নাসিরুদ্দিনের বাহিনীর সাথে যোগ দেন। এবার গৌড় গোবিন্দ পরাজিত হয় এবং সিলেট বাংলা সালতানাতের সাথে যুক্ত হয়। সময়টা ছিল ১৩০৩ সাল। 

একই ধরনের ঘটনা ঘটে মুন্সিগঞ্জে। ১১৭৮ সালে এখানে ইসলাম প্রচার করতে আরব থেকে আসেন হযরত আদম (র.)। তিনি একটি গরু কোরবানি করেন। এতে রাজা বল্লাল সেন ক্রুদ্ধ হয়ে স্বসৈন্যে হযরত আদম (র.) এর বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। বল্লাল সেন আদম (র.)কে অত্যন্ত নৃশংস ভাবে হত্যা করেন। এর প্রতিক্রিয়াতে মুন্সিগঞ্জও বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠা হয়। ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায়।  ব্রিটিশ ফিরিঙ্গিদের আমলে সূর্যাস্ত আইন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ বিভিন্ন আইনের কারনে প্রায় সব মুসলিম জমিদার পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের স্থানে বসানো হয় হিন্দুদের। হিন্দু জমিদাররা পুনরায় তাদের পূর্বোক্ত গৌড় গৌবিন্দ, বল্লাল সেনদের মত গরু কোরবানির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেয়। মুসলমানরা এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সংগ্রাম করে, ব্রিটিশ সরকারকে একাধিকবার স্মারকলিপি দেয়। তবে হিন্দু জমিদাররা চরমতম নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে তা দমন করে। 

ঢাকায় নবাব পরিবারের প্রভাব ছিল, একমাত্র এই ঢাকা ছাড়া সারাদেশে কোথাও মুসলমানরা গরু কোরবানি দিতে পারতো না। সবাই ছাগল(বকরি) কোরবানি দিতো। তাই কালক্রমে ঈদুল আজহা 'বকরির ঈদ' নামে পরিচিতি লাভ করে। এভাবেই চলে শত বছর। এরপর খাজা সলিমুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম লীগ। তারপর শেরে বাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তারপর ১৯৪৭। পূর্ব বাংলা মুক্ত হয় ব্রিটিশ বেনিয়া এবং হিন্দু জমিদারদের কালো হাত থেকে। 



এ সম্পর্কে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, “আজকে আমরা ইদ-উল-আজাহায় কোরবানির জন্য অনায়সে গরু কিনে এনে সহজেই কোরবানি দিয়ে ফেলি। কিন্তু আশি-একশো দুরে থাকুক পঞ্চশ বছর আগেও তা তেমন সহজসাধ্য ছিল না৷ আজকের প্রজন্ম হয়তো অবাক হবে যে, এ নিয়ে সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর বিতর্ক চলেছে৷ এবং কোরবানি (বিশেষ করে গরু কোরবানি) দেওয়ার অধিকার আমাদের বাপ-দাদাদের লড়াই করে আদায় করতে হয়েছে ৷”
( বাংলাদেশের উৎসব, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৩২)

তিনি আরও লিখেছেন, “১৯০৫ সালে চাঁদপুরে কয়েকজন কোরবানি উপলক্ষে গরু কোরবানি দিয়েছিল ৷ এর ফলে জৈনক গোপাল চন্দ্র মজুমদার তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে৷ অভিযোগ ছিলো মুসলমানরা প্রকাশ্য রাস্তায় গরু জবেহ করেছে এবং বদ্ধজলে গোসত ধুয়ে জল অপবিত্র করেছে৷ জেলা হাকিম ছিলো জগদীশচন্দ্র সেন ৷ সে তিনজন মুসলিমকে অভিযুক্ত করে একজনকে এক মাসের জেল এবং অপর দুজনকে যথাক্রমে পঞ্চাশ ও পনের টাকা জরিমানা করেছিল৷”
(প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা, ৩৪ )

তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, “প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক মীর মোশারেফ হোসেন মুসলিম সম্প্রদায়কে হতাশ করে গরু কোরবানীর বিরোধীতা করেন৷ এবং এ নিয়ে তিনি “গো জীবন” নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন ৷ এ জন্য তিনি প্রতিবেশি হিন্দু সমাজের সমর্থনও পান৷ তার গো-জীবন গ্রন্থের মুখবন্ধ দেন এলাহাবাদের গো রক্ষিনী সভার শ্রী শ্রীমান স্বামী৷ গরু কুরবানির বিরোধীতা করার জন্য টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত “মাসিক আখবারে এসলামীয়া” এর সম্পাদক মৌলবী নঈমুদ্দীন কর্তৃক এক জনসভায় মীর মোশারেফ হোসেনকে কাফেরও
ঘোষণা করা হয়েছিল৷ ফলে কবি মীর মোশারেফ হোসেন তার বিরুদ্ধে…

মানহানির মামলা দায়ের করেন৷ সেসময় মৌলবী নঈমুদ্দীন’র পক্ষে এগিয়ে আসে ঢাকা কলেজ, মাদ্রাসা, পোগোজ, জুবিলী, জগন্নাথ, সার্ভে কলেজ, মেডিক্যাল এবং নর্মাল স্কুলের ছাত্ররা৷ তারা মৌলবী নঈমুদ্দীনের পক্ষে জনসভার আয়োজন করে৷ পরবর্তীতে মৌলবী নঈমুদ্দীন ও কবি মীর মোশারেফ হোসেনের মধ্যে আপসের মাধ্যমে মামলাটি প্রতাহার করা হয় ৷
(প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)

উল্লিখিত ইতিহাস দ্বারা এটি প্রতিয়মান হয় যে, বর্তমান এই গরু কোরবানির অধিকার আমাদের পূর্বপুরুষরা কতো কষ্ট করে আদায় করেছেন। তাদের এই ত্যাগ অনুস্বীকার্য। ভারতীয় উপমহাদেশীয় সকল মুসলমানের হৃদয়ে তারা আমরণ স্মরণীয় হয়ে থকবে। আর পরকালে আল্লাহ পাক তাদেরকে উত্তম বিনিময়ে ভূষিত করবেন।

মানহানির মামলা দায়ের করেন৷ সেসময় মৌলবী নঈমুদ্দীন’র পক্ষে এগিয়ে আসে ঢাকা কলেজ, মাদ্রাসা, পোগোজ, জুবিলী, জগন্নাথ, সার্ভে কলেজ, মেডিক্যাল এবং নর্মাল স্কুলের ছাত্ররা৷ তারা মৌলবী নঈমুদ্দীনের পক্ষে জনসভার আয়োজন করে৷ পরবর্তীতে মৌলবী নঈমুদ্দীন ও কবি মীর মোশারেফ হোসেনের মধ্যে আপসের মাধ্যমে মামলাটি প্রতাহার করা হয় ৷
(প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)

উল্লিখিত ইতিহাস দ্বারা এটি প্রতিয়মান হয় যে, বর্তমান এই গরু কোরবানির অধিকার আমাদের পূর্বপুরুষরা কতো কষ্ট করে আদায় করেছেন। তাদের এই ত্যাগ অনুস্বীকার্য। ভারতীয় উপমহাদেশীয় সকল মুসলমানের হৃদয়ে তারা আমরণ স্মরণীয় হয়ে থকবে। আর পরকালে আল্লাহ পাক তাদেরকে উত্তম বিনিময়ে ভূষিত করবেন।

মানহানির মামলা দায়ের করেন৷ সেসময় মৌলবী নঈমুদ্দীন’র পক্ষে এগিয়ে আসে ঢাকা কলেজ, মাদ্রাসা, পোগোজ, জুবিলী, জগন্নাথ, সার্ভে কলেজ, মেডিক্যাল এবং নর্মাল স্কুলের ছাত্ররা৷ তারা মৌলবী নঈমুদ্দীনের পক্ষে জনসভার আয়োজন করে৷ পরবর্তীতে মৌলবী নঈমুদ্দীন ও কবি মীর মোশারেফ হোসেনের মধ্যে আপসের মাধ্যমে মামলাটি প্রতাহার করা হয় ৷
(প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)

উল্লিখিত ইতিহাস দ্বারা এটি প্রতিয়মান হয় যে, বর্তমান এই গরু কোরবানির অধিকার আমাদের পূর্বপুরুষরা কতো কষ্ট করে আদায় করেছেন। তাদের এই ত্যাগ অনুস্বীকার্য। ভারতীয় উপমহাদেশীয় সকল মুসলমানের হৃদয়ে তারা আমরণ স্মরণীয় হয়ে থকবে। আর পরকালে আল্লাহ পাক তাদেরকে উত্তম বিনিময়ে ভূষিত করবেন।

সুবাতাস বইতে শুরু করে। তবে তা একদিনে হয়নি। প্রাক্তন আমলা পি.এ নজির "স্মৃতির পাতা থেকে" শীর্ষক বইয়ে চাকুরী জীবনের কিছু ঘটনা উল্লেখ করেন (এই বইটা সম্ভবত এখন নিষিদ্ধ)। ১৯৫৬ সালেও নাটোরের মানুষ গরু কোরবানি দেবার কথা ভাবতেও পারতো না। উনার উদ্যোগে ১৯৫৭ সালে নাটোর শহরে প্রথমবারের মত গরু কোরবানি দেওয়া হয় তাও বহু কাঠখড় পুড়িয়ে। একের পর এক বাঁধা আসে। একই অবস্থা ছিলো ময়মনসিংহ, যশোরে। গরুর মাংস নেহাৎ একটা খাবার না। গরুর মাংস পূর্ব বাংলার মুসলমানদের শত বছরের সংগ্রামের একটা চিহ্ন। এজন্য সম্ভবত নজরুল কোরবানি কবিতায় বলেছিলেন,

"ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে  সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!

ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।

ভারতীয় উপমহাদেশে গরু কোরবানির ইতিহাস খুবই করুণ ও হৃদয় বিদারক

 ভারতীয় উপমহাদেশে গরু কোরবানির ইতিহাস খুবই করুণ ও হৃদয় বিদারক



কোরবানি হলো আল্লাহ’র পক্ষ থেকে পরীক্ষা। আর এই পরীক্ষা হযরত আদম আ.-এর যুগ থেকেই ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। তবে তাদের পদ্ধতিটা ছিলো ভিন্ন। বর্তমান কোরবানি করা হয় নির্দিষ্ট পশু দ্বারা। এটি শুরু হয় হযরত ইবরাহিম আ.-এর যুগ থেকে। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের পর্যন্ত চলে এসেছে। কোরবানির নির্দিষ্ট পশুর একটি হলো গরু। ভারতীয় উপমহাদেশে গরু কোরবানির ইতিহাস খুবই করুণ ও হৃদয় বিদারক! বর্তমান আমরা তো অনায়েসে গরু দ্বারা কোরবানি করে ফেলি। কোনপ্রকার বাঁধা আসে না। কিন্তু এটি আমাদের পূর্বপুরুষদের পক্ষে অতটা সহজ ছিলো না। বহু কষ্টে এটি সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের অভিনবত্ব সম্ভবত একটা জায়গাতেই, গরুর মাংস। গরুর মাংসের জন্য সংগ্রাম, আন্দোলন এবং রক্ত দিতে হয়েছে, এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে কিনা সন্দেহ। বনী ইসরাইলের সামেরির পরে ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গরু হল পূর্ব বাংলার গরু। 

সিলেটের রাজা গৌড় গৌবিন্দ সম্পর্কে কম বেশি সবারই জানার কথা। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে একজন ব্যক্তি উনার শিশুপুত্রের আকিকার জন্য গরু কুরবানী করেছিলেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে গৌড় গোবিন্দ শেখ বোরহানউদ্দিনের হাত কেটে দেয় এবং শিশু পুত্রকে হত্যা করেন। বোরহানউদ্দিন বাংলার সুলতান শামসউদ্দিন  ফিরোজ শাহের কাছে গিয়ে বিচার প্রার্থনা করেন। ফিরোজ শাহ উনার ভাতিজা সিকান্দার গাজীর নেতৃত্বে একটা সেনাবাহিনী পাঠান। গৌড় গোবিন্দের শক্তিশালী বাহিনীর কাছে সিকান্দার গাজী দুইবার পরাজিত হন। তৃতীয়বার প্রধান সেনাপতি নাসিরুদ্দিনের নেতৃত্বে আবারও অভিযান প্রেরণ করা হয়। এই জিহাদে ৩৬০ জন দরবেশকে নিয়ে হযরত শাহজালাল (র.) নাসিরুদ্দিনের বাহিনীর সাথে যোগ দেন। এবার গৌড় গোবিন্দ পরাজিত হয় এবং সিলেট বাংলা সালতানাতের সাথে যুক্ত হয়। সময়টা ছিল ১৩০৩ সাল। 

একই ধরনের ঘটনা ঘটে মুন্সিগঞ্জে। ১১৭৮ সালে এখানে ইসলাম প্রচার করতে আরব থেকে আসেন হযরত আদম (র.)। তিনি একটি গরু কোরবানি করেন। এতে রাজা বল্লাল সেন ক্রুদ্ধ হয়ে স্বসৈন্যে হযরত আদম (র.) এর বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। বল্লাল সেন আদম (র.)কে অত্যন্ত নৃশংস ভাবে হত্যা করেন। এর প্রতিক্রিয়াতে মুন্সিগঞ্জও বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠা হয়। ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায়।  ব্রিটিশ ফিরিঙ্গিদের আমলে সূর্যাস্ত আইন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ বিভিন্ন আইনের কারনে প্রায় সব মুসলিম জমিদার পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের স্থানে বসানো হয় হিন্দুদের। হিন্দু জমিদাররা পুনরায় তাদের পূর্বোক্ত গৌড় গৌবিন্দ, বল্লাল সেনদের মত গরু কোরবানির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেয়। মুসলমানরা এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সংগ্রাম করে, ব্রিটিশ সরকারকে একাধিকবার স্মারকলিপি দেয়। তবে হিন্দু জমিদাররা চরমতম নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে তা দমন করে। 

ঢাকায় নবাব পরিবারের প্রভাব ছিল, একমাত্র এই ঢাকা ছাড়া সারাদেশে কোথাও মুসলমানরা গরু কোরবানি দিতে পারতো না। সবাই ছাগল(বকরি) কোরবানি দিতো। তাই কালক্রমে ঈদুল আজহা 'বকরির ঈদ' নামে পরিচিতি লাভ করে। এভাবেই চলে শত বছর। এরপর খাজা সলিমুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম লীগ। তারপর শেরে বাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তারপর ১৯৪৭। পূর্ব বাংলা মুক্ত হয় ব্রিটিশ বেনিয়া এবং হিন্দু জমিদারদের কালো হাত থেকে। 



এ সম্পর্কে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, “আজকে আমরা ইদ-উল-আজাহায় কোরবানির জন্য অনায়সে গরু কিনে এনে সহজেই কোরবানি দিয়ে ফেলি। কিন্তু আশি-একশো দুরে থাকুক পঞ্চশ বছর আগেও তা তেমন সহজসাধ্য ছিল না৷ আজকের প্রজন্ম হয়তো অবাক হবে যে, এ নিয়ে সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর বিতর্ক চলেছে৷ এবং কোরবানি (বিশেষ করে গরু কোরবানি) দেওয়ার অধিকার আমাদের বাপ-দাদাদের লড়াই করে আদায় করতে হয়েছে ৷”
( বাংলাদেশের উৎসব, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৩২)

তিনি আরও লিখেছেন, “১৯০৫ সালে চাঁদপুরে কয়েকজন কোরবানি উপলক্ষে গরু কোরবানি দিয়েছিল ৷ এর ফলে জৈনক গোপাল চন্দ্র মজুমদার তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে৷ অভিযোগ ছিলো মুসলমানরা প্রকাশ্য রাস্তায় গরু জবেহ করেছে এবং বদ্ধজলে গোসত ধুয়ে জল অপবিত্র করেছে৷ জেলা হাকিম ছিলো জগদীশচন্দ্র সেন ৷ সে তিনজন মুসলিমকে অভিযুক্ত করে একজনকে এক মাসের জেল এবং অপর দুজনকে যথাক্রমে পঞ্চাশ ও পনের টাকা জরিমানা করেছিল৷”
(প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা, ৩৪ )

তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, “প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক মীর মোশারেফ হোসেন মুসলিম সম্প্রদায়কে হতাশ করে গরু কোরবানীর বিরোধীতা করেন৷ এবং এ নিয়ে তিনি “গো জীবন” নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন ৷ এ জন্য তিনি প্রতিবেশি হিন্দু সমাজের সমর্থনও পান৷ তার গো-জীবন গ্রন্থের মুখবন্ধ দেন এলাহাবাদের গো রক্ষিনী সভার শ্রী শ্রীমান স্বামী৷ গরু কুরবানির বিরোধীতা করার জন্য টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত “মাসিক আখবারে এসলামীয়া” এর সম্পাদক মৌলবী নঈমুদ্দীন কর্তৃক এক জনসভায় মীর মোশারেফ হোসেনকে কাফেরও
ঘোষণা করা হয়েছিল৷ ফলে কবি মীর মোশারেফ হোসেন তার বিরুদ্ধে…

মানহানির মামলা দায়ের করেন৷ সেসময় মৌলবী নঈমুদ্দীন’র পক্ষে এগিয়ে আসে ঢাকা কলেজ, মাদ্রাসা, পোগোজ, জুবিলী, জগন্নাথ, সার্ভে কলেজ, মেডিক্যাল এবং নর্মাল স্কুলের ছাত্ররা৷ তারা মৌলবী নঈমুদ্দীনের পক্ষে জনসভার আয়োজন করে৷ পরবর্তীতে মৌলবী নঈমুদ্দীন ও কবি মীর মোশারেফ হোসেনের মধ্যে আপসের মাধ্যমে মামলাটি প্রতাহার করা হয় ৷
(প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)

উল্লিখিত ইতিহাস দ্বারা এটি প্রতিয়মান হয় যে, বর্তমান এই গরু কোরবানির অধিকার আমাদের পূর্বপুরুষরা কতো কষ্ট করে আদায় করেছেন। তাদের এই ত্যাগ অনুস্বীকার্য। ভারতীয় উপমহাদেশীয় সকল মুসলমানের হৃদয়ে তারা আমরণ স্মরণীয় হয়ে থকবে। আর পরকালে আল্লাহ পাক তাদেরকে উত্তম বিনিময়ে ভূষিত করবেন।

মানহানির মামলা দায়ের করেন৷ সেসময় মৌলবী নঈমুদ্দীন’র পক্ষে এগিয়ে আসে ঢাকা কলেজ, মাদ্রাসা, পোগোজ, জুবিলী, জগন্নাথ, সার্ভে কলেজ, মেডিক্যাল এবং নর্মাল স্কুলের ছাত্ররা৷ তারা মৌলবী নঈমুদ্দীনের পক্ষে জনসভার আয়োজন করে৷ পরবর্তীতে মৌলবী নঈমুদ্দীন ও কবি মীর মোশারেফ হোসেনের মধ্যে আপসের মাধ্যমে মামলাটি প্রতাহার করা হয় ৷
(প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)

উল্লিখিত ইতিহাস দ্বারা এটি প্রতিয়মান হয় যে, বর্তমান এই গরু কোরবানির অধিকার আমাদের পূর্বপুরুষরা কতো কষ্ট করে আদায় করেছেন। তাদের এই ত্যাগ অনুস্বীকার্য। ভারতীয় উপমহাদেশীয় সকল মুসলমানের হৃদয়ে তারা আমরণ স্মরণীয় হয়ে থকবে। আর পরকালে আল্লাহ পাক তাদেরকে উত্তম বিনিময়ে ভূষিত করবেন।

মানহানির মামলা দায়ের করেন৷ সেসময় মৌলবী নঈমুদ্দীন’র পক্ষে এগিয়ে আসে ঢাকা কলেজ, মাদ্রাসা, পোগোজ, জুবিলী, জগন্নাথ, সার্ভে কলেজ, মেডিক্যাল এবং নর্মাল স্কুলের ছাত্ররা৷ তারা মৌলবী নঈমুদ্দীনের পক্ষে জনসভার আয়োজন করে৷ পরবর্তীতে মৌলবী নঈমুদ্দীন ও কবি মীর মোশারেফ হোসেনের মধ্যে আপসের মাধ্যমে মামলাটি প্রতাহার করা হয় ৷
(প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)

উল্লিখিত ইতিহাস দ্বারা এটি প্রতিয়মান হয় যে, বর্তমান এই গরু কোরবানির অধিকার আমাদের পূর্বপুরুষরা কতো কষ্ট করে আদায় করেছেন। তাদের এই ত্যাগ অনুস্বীকার্য। ভারতীয় উপমহাদেশীয় সকল মুসলমানের হৃদয়ে তারা আমরণ স্মরণীয় হয়ে থকবে। আর পরকালে আল্লাহ পাক তাদেরকে উত্তম বিনিময়ে ভূষিত করবেন।

সুবাতাস বইতে শুরু করে। তবে তা একদিনে হয়নি। প্রাক্তন আমলা পি.এ নজির "স্মৃতির পাতা থেকে" শীর্ষক বইয়ে চাকুরী জীবনের কিছু ঘটনা উল্লেখ করেন (এই বইটা সম্ভবত এখন নিষিদ্ধ)। ১৯৫৬ সালেও নাটোরের মানুষ গরু কোরবানি দেবার কথা ভাবতেও পারতো না। উনার উদ্যোগে ১৯৫৭ সালে নাটোর শহরে প্রথমবারের মত গরু কোরবানি দেওয়া হয় তাও বহু কাঠখড় পুড়িয়ে। একের পর এক বাঁধা আসে। একই অবস্থা ছিলো ময়মনসিংহ, যশোরে। গরুর মাংস নেহাৎ একটা খাবার না। গরুর মাংস পূর্ব বাংলার মুসলমানদের শত বছরের সংগ্রামের একটা চিহ্ন। এজন্য সম্ভবত নজরুল কোরবানি কবিতায় বলেছিলেন,

"ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।

ওরে  সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!

ওরে   হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।

Saturday 3 July 2021

ইংরেজপ্রেমী হিন্দু ও বঙ্কিম

 ইংরেজপ্রেমী হিন্দু ও বঙ্কিম 



মুসলমান জাতির প্রতি বঙ্কিমের ধারণা কী ছিল তার একটা নমুনা: ‘‘ঢাকাতে দুইচারিদিন বাস করিলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়নপথের পথিক হইবে— কাক, কুকুর এবং মুসলমান। এই তিনটিই সমভাবে কলহপ্রিয়, অতি দুর্দ্দম, অজেয়। ক্রিয়া বাড়ীতে কাক আর কুকুর, আদালতে মুসলমান।’’ (বঙ্গদর্শন)। শুধু সাম্প্রদায়িক নয়, বঙ্কিমকে ইংরেজপ্রেমিক এবং দেশদ্রোহী বলতেও বাধা নেই। আনন্দমঠে লিখেছেন, ‘‘মুসলমানের পর ইংরেজ রাজা হইল, হিন্দু প্রজা তাহাতে কথা কহিল না। বরং হিন্দুরাই রাজ্য জয় করিয়া ইংরাজকে দিল। কেননা হিন্দুর ইংরাজের উপর ভিন্ন জাতীয় বলিয়া কোন দ্বেষ নাই।’’ দেশবাসীর স্বাধীনতার স্বপ্নকে বঙ্কিম ব্যঙ্গ করে লিখলেন, ‘‘স্বাধীনতা দেশী কথা নহে, বিলাতী আমদানী, লিবার্টি শব্দের অনুবাদ... ইহার এমন তাৎপর্য্য নয় যে, রাজা স্বদেশীয় হইতেই হইবে।’’ আরও লিখলেন, ‘‘ইংরেজ ভারতবর্ষের পরম উপকারী। ইংরেজ আমাদিগকে নতুন কথা শিখাইতেছে... যে সকল শিক্ষার মধ্যে অনেক শিক্ষা অমূল্য। যে সকল অমূল্য রত্ন আমরা ইংরেজদের চিত্তভাণ্ডার হইতে লাভ করিতেছি, তাহার মধ্যে দুইটি... স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়তা এবং জাতিপ্রতিষ্ঠা। ইহা কাহাকে বলে হিন্দু জানিত না।’’ (বঙ্কিম রচনাবলি, পৃ ২৪০)।


দেশের তাঁতশিল্পকে ধ্বংস করে সরকার গরিব মুসলিম তাঁতশিল্পীদের ভাতে মারল। বঙ্কিম লিখলেন, ‘‘তাহার তাঁত বোনা ব্যবসায় লোপ পাইয়াছে বটে, কিন্তু সে অন্য ব্যবসা করুক না কেন?... তাঁত বুনিয়া আর খাইতে পায় না, কিন্তু ধান বুনিয়া খাইবার কোন বাধা নাই।’’ (বঙ্কিম রচনাবলি, ২য় খণ্ড, পৃ ৩১১)।


ইংরেজপ্রেমিক বঙ্কিম ১৮৯৪ সালে মৃত্যুর মাত্র কিছু দিন পূর্বে সরকারের কাছ থেকে সিআইই (কম্প্যানিয়ন অব দি ইন্ডিয়ান এম্পায়ার) খেতাব লাভ করেন, যার অর্থ ‘ভারত সাম্রাজ্যের সহযোগী’।

Wednesday 9 June 2021

বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় আবারও ঢাকা শীর্ষে

 

বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় আবারও ঢাকা শীর্ষে

মুহাম্মদ নূরে আলম: বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় আবারও নাম লেখাল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। বিশ্বের বাসযোগ্য শহরের নতুন তালিকা প্রকাশ করেছে দ্য ইকোনমিস্টের সিস্টার কোম্পানি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শহরের ওপর জরিপ চালিয়েছে সংস্থাটি। তালিকায় ১৪০টি দেশের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। বসবাসের যোগ্য শহরগুলোর তালিকায় ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭। এ বছর ৩৩ দশমিক পাঁচ পয়েন্ট নিয়ে সর্বশেষ ঘোষিত তালিকার চেয়ে একধাপ এগিয়েছে ঢাকা। এ বছর ঢাকা স্থিতিশীলতায় ৫৫, স্বাস্থ্যসেবায় ১৬ দশমিক সাত, সংস্কৃতি ও পরিবেশে ৩০ দশমিক আট, শিক্ষায় ৩৩ দশমিক তিন এবং অবকাঠামোতে ২৬ দশমিক আট পয়েন্ট পেয়েছে। ২০১৯ সালে তালিকার ১৩৮ নম্বরে থাকলেও এবার রয়েছে ১৩৭ নম্বরে। এর আগে ২০১৮ সালে ঢাকা ছিল এই তালিকার ১৩৯তম শহর। অর্থাৎ ঢাকা মোটেও বসবাসের যোগ্য শহর নয়। এর আগেও শহরটি বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। করোনা মহামারির কারণে লকডাউন থাকা শহরের তথ্য সংগ্রহ করতে না পারায় ২০২০ সালের তালিকা করার কাজ বাতিল করে ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।
নগরপরিকল্পনাবিদ, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজধানী ঢাকা আর নাগরিক সমস্যা সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে বহু আগেই। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী দখলদারিত্বের কবলে পড়ে আবদ্ধ জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে দুর্বিষহ যানজট, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সঙ্কট, পয়ঃনিষ্কাশনের জটিলতা, দুর্গন্ধময় ও বিষাক্ত বাতাস, দূষিত পরিবেশ, অত্যন্ত ঘনবসতি, ভেজাল খাবার, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্দশা, জলাবদ্ধতা, ফুটপাথ দখল, চাঁদাবাজি, মাদকের ভয়াল ছোবল, ছিনতাই, আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য, লাগামহীন বাসাভাড়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ইত্যাদি সমস্যা। অসংখ্য সমস্যার মধ্যে যেটি প্রধান হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে যানজট। এ সমস্যা এখন নিত্যদিনের বিষয়। যানজটে মানুষের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার হিসাব বিভিন্ন সংস্থা দিয়েছে। বুয়েটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যানজটের কারণে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসি বলেছে, এর পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ জাতিসঙ্ঘের ইউএনডিপি বলেছে, যানজটে বছরে ক্ষতি ৩৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
দ্য ইকোনমিস্টের সিস্টার কোম্পানি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-ইআইইউ মতে, ২০২১ সালের সর্বশেষ এ জরিপে বসবাসের যোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড। দ্বিতীয় ওসাকা, তৃতীয় অ্যাডিলেড, চতুর্থ টোকিও এবং পঞ্চম ওয়েলিংটন, ৬ষ্ঠ পার্থ, সপ্তম জুরিখ, অষ্টম জেনেভা, নবম মেলবোর্ন ও দশম স্থানে ব্রিসবেন। অর্থাৎ বসবাসযোগ্য শীর্ষ ১০টি শহরের মধ্যে নিউজিল্যান্ডের দুটি, জাপানের দুটি, অস্ট্রেলিয়ার চারটি এবং সুইজারল্যান্ডের দুটি শহর রয়েছে।
করোনা মহামারির কারণে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় এবার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা এই তালিকায় শীর্ষে ছিল। কিন্তু এবার শীর্ষ ১০ শহরের মধ্যে স্থানই পায়নি ভিয়েনা। ২০১৯ সালে ভিয়েনার সঙ্গে একই পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থান ছিল অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। এদিকে এর আগের বছর বসবাসের যোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৮তম। সে হিসেবে এবার ঢাকার অবস্থার একধাপ এগিয়েছে বলা যায়। এ তালিকাও সন্তোষজনক নয় বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইআইইউ-এর জরিপ অনুযায়ী বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় একেবারে শেষে রয়েছে সিরিয়ার দামেস্ক শহর। এ শহরের অবস্থান ১৪০তম। অর্থাৎ যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরটি একেবারেই বসবাসের অযোগ্য। অন্যদিকে বসবাসের যোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার চেয়ে কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তানের করাচি। শহরটির অবস্থান ১৩৪। এছাড়া ১৩৫তম অবস্থানে লিবিয়ার ত্রিপোলি, ১৩৬তম আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স, ১৩৮তম পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোরেসবি এবং ১৩৯তম অবস্থানে রয়েছে নাইজেরিয়ার লাগোস। উল্লেখ্য, বিশ্বের ১৪০টি দেশের সংস্কৃতি, জলবায়ু, পরিবেশ, শিক্ষা, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও জীবনযাপনের মানের ওপর ভিত্তি করে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বৈশ্বিক বাসযোগ্য শহরের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিয়েনাকে টপকে এবারের বসবাস যোগ্য শহরের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে অকল্যান্ড। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে ১৪০টি শহরের এই তালিকা তৈরি করে।
ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিলের সভাপতি মো. আবুল হাসান ও মহাসচিব খন রঞ্জন রায় বলেন, ঢাকা মহানগরে যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন নির্মাণকাজের কারণে বায়ুদূষণ আশঙ্কাজনক। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চক্করে এর মাত্রা সবচেয়ে বেশি। সেখানে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পার্টিকুলেট মেটার (পিএম) ১৭২ মাইক্রোগ্রাম। অথচ জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য পিএম ৬৫ মাইক্রোগ্রাম। জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতিও ভয়াবহ।
তারা আরও বলেন, রাজধানী ঢাকায় মশাবাহিত রোগের প্রকোপ দিনদিন বাড়ছে; যেমন- চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু প্রভৃতির ঝুঁকি রয়েছে ব্যাপক। ময়লা-আবর্জনার কারণে দূষিত পরিবেশ; পেটের পীড়া, জন্ডিস ও টাইফয়েড আক্রান্ত হয় বহু মানুষ। ঢাকার একটি বার্ষিক ব্যাধি ডায়রিয়া। বছরে অন্তত দু’বার, বর্ষার শুরুতে ও শেষে এটা দেখা দেয়।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ঢাকার মলমূত্রের মাত্র ২ শতাংশের নিরাপদ নিষ্কাশন হচ্ছে। বাকিটা মিশে যায় প্রকৃতিতে, পানির উৎসে। বিবিএস ও ইউনিসেফের তথ্য মতে, ঢাকায় সরবরাহ করা পানির দুই-তৃতীয়াংশেই মলবাহিত জীবাণু থাকে। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ঝুঁকি। স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো নয় বলে একটু বৃষ্টি হলেই স্যুয়ারেজ, ড্রেন আর পাইপের পানি একাকার হয়ে যায়।
পরিবেশ আন্দোলন বাপার মতে, রাজধানী ঢাকায় জলাবদ্ধতা অত্যন্ত প্রকট সমস্যা। ঘণ্টাখানেকের বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় ঢাকার রাস্তাঘাট। কিছু এলাকা; যেমন- মিরপুর, মানিক নগর, মালিবাগ, ওয়্যারলেস, তেজগাঁও, কালশী রোড, দৈনিক বাংলা মোড় প্রভৃতি স্থানে রাস্তায় পানি থই থই করে। অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী ও অফিসগামী যাত্রীরা। বেশির ভাগ রাস্তা ও গলি অপ্রশস্ত, ইট-খোয়া-বিটুমিন ওঠা, ময়লায় ভর্তি। এসবের ফল অসহ্য যানজট। রাস্তার সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ নেই। সারা বছরই খোঁড়াখুঁড়ি চলে।
সূত্রে জানাযায়, দেশের সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে স্বাস্থ্য, কৃষি, মেরিন প্রকৌশল শিক্ষায় ১১৭২টি ইনস্টিটিউটের মধ্যে ঢাকাতেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অর্ধেকের বেশি- ৬১৮টি। বাকি ৫৫৪টি করা হয়েছে ৩৩টি জেলায়। ৩০টি জেলায় কোনো ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট আজো প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। ঢাকা শহরের জনসংখ্যার চাপ হ্রাস করতে প্রতিটি উপজেলায়-জেলায় ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট নির্মাণ করে কলকারখানা, খামার, হাসপাতাল, ক্লিনিকে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নামবিও’র প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯-এ এই তথ্য উঠে এসেছে। নামবিওর তথ্য থেকে জানা যায়, আগে ২০১৮ এবং ২০১৭ সালে যানজটে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। তার আগে ২০১৬ সালে ঢাকার অবস্থান ছিল তৃতীয়। কিন্তু মাত্র তিন বছর আগে ২০১৫ সালে ঢাকা ছিল অষ্টম। বসবাস অযোগ্যতায় তিন বছরে দুই ধাপ উন্নতি হলেও যানজটের দিক দিয়ে চার বছরে আট ধাপ অবনতি হয়ে আমরা প্রথম হয়ে গেছি। বিভিন্ন দেশের রাজধানী এবং গুরুত্বপূর্ণ ২০৭টি শহরকে বিবেচনায় নিয়ে এ তালিকা প্রণয়ন করেছে নামবিও। এ ক্ষেত্রে তারা সময় অপচয়, অদক্ষতা ও কার্বন-নিঃসরণকে বিবেচনায় নিয়েছে। বিশ্বের অনিরাপদ নগরীর তালিকায়ও ঢাকা তৃতীয়। এই তালিকাটিও করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। এদিকে বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত রাজধানী ঢাকা, সবচেয়ে দূষিত বাংলাদেশ। ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত বিশ্ব বায়ুর মান যাচাই করে দেয়া রিপোর্ট থেকে এমন তথ্যই উঠে এসেছিল।
বাতাসে ক্ষুদ্র কণিকার উপস্থিতির পরিমাণ হিসাব করে বায়ুদূষণের মাত্রা হিসাব করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ডব্লিউএইচও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনা করে বাতাসে ক্ষুদ্র কণিকার গড় মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে সর্বোচ্চ ১০ মাইক্রোগ্রাম নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু ঢাকার বাতাসে এই কণিকার মাত্রা ২০১৮ সালে প্রতি ঘনমিটারে পাওয়া যায় ৯৭ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম, যা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা পাকিস্তান ও ভারতের বাতাসে ক্ষুদ্র কণিকার মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে যথাক্রমে ৭৪ দশমিক ৩ ও ৭২ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম ছিল। এই বায়ুদূষণের জন্য দায়ী করা হয় ঢাকার আশপাশের ইটভাটা, ঢাকার নির্মাণকাজ, যানবাহনে ব্যবহৃত জ্বালানি, বর্জ্য পোড়ানো ইত্যাদি। ঢাকার এই অধঃপতন নিয়ে বছর দেড়েক আগে দৈনিক প্রথম আলো তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছিল, থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের করা এক তালিকায় নারীদের জন্য সবচেয়ে খারাপ মহানগরের মধ্যে বিশ্বে সপ্তম স্থানে আছে ঢাকা। যৌন সহিংসতা বিবেচনায় নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ; এখানে বাংলাদেশের স্থান চতুর্থ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা জিপজেটের করা পর্যবেক্ষণের ফলাফল অনুযায়ী বিশ্বে সবচেয়ে শারীরিক ও মানসিক চাপের শহরগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে আছে ঢাকা।
এদিকে শব্দদূষণ যে আমাদের জন্য নীরব ঘাতক হিসেবে নিত্যসঙ্গী হয়ে আছে, সেটা তো বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই জানান দিচ্ছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা!  শব্দ দূষণকে বলা হয় নীরব ঘাতক। আর বিশেষ করে ঢাকা শহরে শব্দ দূষণের বহু উৎস রয়েছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার, শিল্পকারখানা কোন ক্ষেত্রেই শব্দ দূষণ বিষয়ে যেসব নিয়ম রয়েছে তা মানা হচ্ছে না। শ্রবণজনিত সমস্যায় আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দেশে ৫৭ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ শ্রবণ সমস্যায় ভুগছেন। এরমধ্যে শব্দদূষণের কারণে শহর এলাকার মানুষের শ্রবণশক্তি বেশি নষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পুরো ঢাকা শহরই এখন শব্দ দূষণের শিকার। ঢাকা শহরে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে শব্দের মাত্রা স্বাভাবিক আছে। শহরের প্রায় সব এলাকাতেই শব্দ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ঢাকার জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ কোনো-না-কোনো ধরনের বধিরতায় আক্রান্ত হবেন। শব্দের মাত্রার একককে বলা হয় ডেসিবেল। দেশে বধিরতার কারণে বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষ কর্মহীন জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। অপরদিকে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ কোনো না কোনো মাত্রার শ্রবণ সমস্যায় ভুগছেন। বধিরতা সমস্যার উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে মধ্যকর্ণের প্রদাহ, আঘাতজনিত সমস্যা, উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে সৃষ্ট বধিরতা। শব্দদূষণের মধ্যে রয়েছে উচ্চমাত্রার শব্দে হেডফোন দিয়ে গান শোনা, উচ্চমাত্রার হর্ন বাজানো, লাউডস্পিকারের শব্দ ইত্যাদি।
বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের রহস্যময় ধোঁয়া শনাক্ত করেছে একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান জিএইচজিস্যাট গত ১৭ এপ্রিল সংস্থার হুগো স্যাটেলাইটের পর্যবেক্ষণে ঢাকার অদূরে মাতুয়াইল ময়লার ভাগাড় থেকে উদ্ভূত একটি মিথেনের উৎসের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট স্টিফেন জার্মেইন। সংস্থাটির অনুমান, মাতুয়াইল ময়লার ভাগাড় থেকে প্রতিঘণ্টায় ৪০০০ কেজি মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যাচ্ছে, যা ১,৯০,০০০ গাড়ির বায়ুদূষণের সমান দূষণ। পৃথিবীর ১২টা মিথেন এমিসন হটস্পটের একটি বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই ছিল, কিন্তু স্রেফ একটা স্থান থেকে এই বিপুল পরিমাণে মিথেন নিঃসরণের উদাহরণ এই মুহূর্তে খুবই বিরল। জীবন আছে এমন জিনিস পচে গিয়ে উৎপন্ন হয় মিথেন গ্যাস।

Saturday 15 May 2021

বেলফোর ঘোষণাঃ ফিলিস্তিন নিয়ে ব্রিটিশদের চক্রান্ত

 বেলফোর ঘোষণাঃ ফিলিস্তিন নিয়ে ব্রিটিশদের চক্রান্ত।



ব্রিটিশ সরকারের মুসলিম বিদ্বেষী পলিসির কারনে ফিলিস্তিনের মুসলমানরা ১০৪ বছর ধরে ইহুদীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ব্রিটিশ সরকারের পলিসির প্রতি তীব্র ঘৃণা ধিক্কার।  


ফিলিস্তিনীদের সাথে চক্রান্ত করে ইহুদীদের স্বার্থে ব্রিটেন কর্তৃক দেওয়া বেলফোর ঘোষণার ১০২ তম পূর্তি আজ। ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বরের দেওয়া ওই ঘোষণা ফিলিস্তিনীদের মধ্যে ব্যাপক উথান ঘটিয়েছিল। ওই ঘোষণা জায়ানিস্টদের ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল যখন ব্রিটেন, "সকল ইহুদীদের আবাসস্থল" বলে ফিলিস্তিনীদের ভূমিতে ইহুদীদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। বেলফোর ঘোষণাকে ১৯৪৮ সালে ইহুদীদের কর্তৃক ফিলিস্তিনীদের ওপর দমন,পীড়ন, নির্যাতন চালিয়ে নিজ ভূমি থেকে তাদের বিতাড়িত করার বর্বর ইতিহাসের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।


বেলফোর ঘোষণাটি কী ছিলো?

The Balfour Declaration (বেলফোর প্রতিশ্রুতি) ছিলো ১৯১৭ সালে ব্রিটেন কর্তৃক নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুত ঘোষণা, "a national home for the Jewish people"। অর্থাৎ ইহুদীদের জন্য ইহুদী রাষ্ট্র তৈরির ঘোষণা। ব্রিটেনের ওই ঘোষণাটি পত্র আকারে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব আর্থার বেলফোরের পক্ষ থেকে ব্রিটিনে ইহুদীর একটি বড় সংগঠন British Jews Community এর প্রধান ওয়াল্টার রথসচাইল্ডকে উদ্দেশ্য করে বিবৃত করা হয়।


বেলফোর ঘোষণাটি দেওয়া হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯১৪ - ১৯১৮) সালের দিকে, ফিলিস্তিনের জন্য ব্রিটিশ মেন্ডেটের আওতার শর্তে। ঘোষণাটি দেওয়া হয় যখন অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে যায় এরপর। ব্রিটিশ মেন্ডেট ফিলিস্তিন" নামে মেন্ডেট পদ্ধতির মূলে ছিলো যৌথ শক্তি কর্তৃক নিয়ন্ত্রণের নামে ব্রিটেন কর্তৃক ফিলিস্তিনে অবৈধভাবে উপনিবেশবাদ এবং দখলদারিত্বের শাসন। মেন্ডেট সিস্টেমে ১ম বিশ্ব যুদ্ধে পরাজিত শক্তিদের জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাংগেরি, অটোমান সাম্রাজ্য এবং বুলগেরিয়ার হাত থেকে বিভিন্ন রাজ্য পরিচালনার ভার যুদ্ধে জয়ী শক্তির আওতায় চলে যায়। ফিলিস্তিন নিয়ে ব্রিটিশ মেন্ডেটের মূল উদ্দেশ্য ছিলো সেখানে ইহুদী রাষ্ট্র তৈরির পরিবেশ তৈরি করা যখন সেখানে মাত্র ১০ ভাগ ইহুদী ছিলো।



ব্রিটিশ মেন্ডেট সিস্টেম শুরুর পর ব্রিটিশরা ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদীদের ফিলিস্তিনে পাঠাতে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে থাকে। ১৯২২ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে ইহুদীদের সংখ্যা সেখানে বেড়ে দাঁড়ায় মূল জনসংখ্যার মধ্যে ২৭ ভাগে। যদিও বেলফোর ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়েছিল এমন কিছু করা হবেনা যা নাগরিক এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য পক্ষপাতদুষ্ট হবে কিন্তু ব্রিটিশ মেন্ডেট এমনভাবে গঠন করা হয়েছিল যা ইহুদীদের বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে ফিলিস্তিনীদের ওপর ইহুদীদের নিজেদের কর্তৃত্বশীল ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল।


বেলফোর ঘোষণা বিতর্কিত ছিলো কেনো?


বেলফোর ঘোষণা নানা কারণে ছিলো বিতর্কিত। প্রথমত, ফিলিস্তিনী আমেরিকান পণ্ডিত এডওয়ার্ডের ভাষায়, "ইউরোপিয়ান একটি দেশ কর্তৃক অ ইউরোপীয় একটি ভূখণ্ডের বিষয়ে ঘোষণা যেখানে ওই ঘোষণা ওই ভূখণ্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দার অস্তিত্ব এবং মতামতকে যেখানে উপেক্ষা করে।" সংক্ষেপে, বেলফোর ঘোষণা একটি ইহুদী ভূখণ্ড তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যেখানে স্থানীয় অধিবাসীদের সংখ্যাই ছিলো ৯০ ভাগ। দ্বিতীয়ত, ঘোষণাটি ছিলো ব্রিটিশদের যুদ্ধ চলাকালীন দেওয়া তিনটি পারস্পরিক সাংঘর্ষিক প্রতিশ্রুতির একটি। যখন এটি প্রকাশ করা হয়, ব্রিটেন ইতোমধ্যেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অটোমান সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন আরব রাষ্ট্রের সৃষ্টির।



"Hussein-McMahon correspondence" নামের ঐতিহাসিক পত্র বিনিময় যেখানে ব্রিটিশ এবং শরীফ আল মক্কা নামে পরিচিত সৌদি ধর্মীয় নেতা হোসাইন বিন আলির ১৯১৫ সালের দিকে পত্র বিনিময়ের মধ্যে ওই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। যেখানে হোসাইন বিন আলি অটোমান শাসনের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহ ঘোষণা করে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ওই প্রতিশ্রুতি চেয়েছিল। ব্রিটিশরা "1916 Sykes-Picot agreement" নামের সাইক পিকট চুক্তির আওতায় ফরাসিদেরও আলাদাভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিন অঞ্চল আন্তর্জাতিক প্রশাসনের অধীন থাকবে। অন্যদিকে অন্যান্য এলাকাগুলো যুদ্ধের পর দুই ঔপনিবেশিক শক্তির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। ওই ঘোষণা যাইহোক এটাই বুঝিয়েছিল, ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের দখলে থাকবে এবং ফিলিস্তিনী আরব যারা সেখানে থাকবে তারা কখনো স্বাধীন রাষ্ট্র পাবেনা।


পরিশেষে, বেলফোর ঘোষণা এমন একটি ধারণার ("national home" বা জাতীয় আবাস ) পরিচিতি ঘটিয়েছিল যা আন্তর্জাতিক আইনে ছিলো নজিরহীন।পুরনো নথিগুলোতে, "ইহুদী রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের পুনর্গঠন" বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে পরিবর্তন হয়ে যায়। ১৯২২ সালে ইহুদিবাদী নেতা চেইম ওয়েইজম্যান সাথে একটি সাক্ষাতে আর্থার বেলফোর এবং পরে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লাইওয়েড জর্জ বেলফোরের ঘোষণাকে, ''চূড়ান্ত ইহুদীরাষ্ট্র সৃষ্টির প্রক্রিয়া'' বলে জানায়।


কেন এই ঘোষণা জারি করা হলো? বেলফোর ঘোষণা কেনো জারি করা হলো এটা কয়েক দশক ধরে বিতর্কিত বিষয়। ঐতিহাসিকেরা বিভিন্ন উৎস থেকে এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছে। অনেকে যুক্তি সহকারে কারণ হিসেবে তুলে ধরছে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারে থাকা অধিকাংশ ইহুদীবাদী কর্মকর্তাকে। অনেকে ওই ঘোষণাকে ইহুদীদের সাথে বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি কার্যকারী ঘোষণা বলে মনে করে যেখানে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ইহুদীদের দিয়ে দিলে ইহুদীদের সমস্যার সমাধান হবে। মূলধারার গবেষকদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে যেসব কারণগুলো উল্লেখ করা হয় সেগুলো হলোঃ ফিলিস্তিনের ওপর নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য ছিলো ব্রিটেনের মিশর এবং সুয়েজ খালকে নিজেদের প্রভাব গোলকের মধ্যে রাখা।

ব্রিটেন ইহুদিবাদীদের পক্ষ নিয়েছিল আমেরিকা এবং রাশিয়ায় ইহুদীদের আন্দোলনকে বেগবান করে তাদের সরকারকে যুদ্ধে জয়লাভ পর্যন্ত জড়িয়ে রাখার জন্য।

ব্রিটিশ সরকারে ইহুদীবাদী লবিদের সাথে মজবুত সম্পর্ক ও তীব্র প্রভাব বিদ্যমান থাকায়। ব্রিটিশ সরকারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ছিলো ইহুদী।

ইহুদীরা ইউরোপ জুড়ে নিপীড়িত হয়েছিল বলে ব্রিটিশ সরকার তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে চেয়েছিল।

ফিলিস্তিনী ও আরবেরা বেলফোর ঘোষণাকে কীভাবে নিয়েছিল?


১৯১৯ সালে, পরবর্তীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওউড্রো উইলসন একটি কমিশন গঠন করে সিরিয়া এবং ফিলিস্তিনের মেন্ডাটরি পদ্ধতির বিষয়ে জনসাধারণের মতামত জানার জন্য। ওই অনুসন্ধান "কিং-ক্রেন" কমিশন নামে পরিচিত হয়। ওই কমিশন অনুসন্ধানের ফলাফল পায় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনী তীব্র ইহুদিবাদ বিরোধী এবং ওই কমিশন মেন্ডেটের উদ্দেশ্য পরিবর্তনের পরামর্শ প্রদান করে।

প্রয়াত ফিলিস্তিনী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আউনি আবেদ আল হাদি বেলফোর ঘোষণার বিরুদ্ধে নিজের স্মৃতি থেকে উল্লেখ করেন, "এটি ছিলো এক বিদেশী ইংরেজের তৈরি যার ফিলিস্তিন নিয়ে কিছু করার অধিকার নেই, বিদেশী ইহুদী যাদের এখানে কোনো অধিকার নেই।"


১৯২০ সালে, হাইফায় তৃতীয় ফিলিস্তিনী কংগ্রেসে ব্রিটিশ সরকারের ইহুদীবাদী পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী ঘোষণার নিন্দা করা হয় যেখানে স্থানীয় অধিবাসীদের অধিকারও খর্বিত হচ্ছে। ১৯১৯ সালের নভেম্বরে যখন দামেস্ক ভিত্তিক আল ইস্তিকলাল আল আরাবি পত্রিকা নতুন করে প্রকাশিত হলো সেখানে একটি আর্টিকেলে লন্ডনের মন্ত্রীসভার ইহুদী মন্ত্রী হারবার্ট সামুয়েলের বেলফোর ঘোষণার দ্বিতীয় একটি ভাষণের সমালোচনা করে উল্লেখ করা হয়, আমাদের দেশ আরব, ফিলিস্তিন আরব এবং ফিলিস্তিন অবশ্যই আরবদের থাকবে"।


বেলফোর ঘোষণা এবং ব্রিটিশ মেন্ডেট প্রতিষ্ঠার আরো পূর্বে, আরব জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলো ফিলিস্তিনীদের নিজ ভূখণ্ড থেকে সরানোর ইহুদীবাদ আন্দোলনের বিষয়ে সতর্ক করেছিল। খলিল সাকাকিনি, মাকদিসের (জেরুসালেমের বাসিন্দা) বাসিন্দা এবং অর্থোডক্স খ্রিস্টান শিক্ষক যুদ্ধের পরপর ফিলিস্তিনের বর্ণনা করেছিলেন এভাবে, "এক জাতি যারা দীর্ঘকাল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো তারা কেবল তখনই জাগে যখন রুক্ষভাবে বিভিন্ন ঘটনা ঝাঁকিয়ে তুলে এবং কেবল ধীরে ধীরে জেগে উঠে......"। এটিই ছিলো ফিলিস্তিনের অবস্থা, কয়েক শতাব্দী ধরে গভীর ঘুমে আছন্ন ছিলো যে পর্যন্ত না মহাযুদ্ধ শুরু হলো, ইহুদীবাদ আন্দোলনের কারণে বিস্মিত হলো, অধিকার খর্বিত হলো, এবং ধীরে ধীরে তারা জাগতে শুরু করলো।"


মেন্ডেটের অধীনে ইহুদী অভিবাসীদের ক্রমাগত সংখ্যা বৃদ্ধি উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং ফিলিস্তিনী আরব ও ইহুদীদের মধ্যে সহিংসতা বৃদ্ধি হচ্ছিল। ব্রিটিশদের ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে প্রথম সাড়া জাগানো প্রতিক্রিয়া ছিলো "নবী মুসা বিদ্রোহ" বলে পরিচিত ১৯২০ সালের আরব ফিলিস্তিনী ও ইহুদীদের মধ্যকার দাঙ্গা যেখানে ৫ ইহুদী অভিবাসী নিহত ও ৪ ফিলিস্তিনী শাহাদাতবরণ করে এবং বহু হতাহত হয়। নবী মূসা আঃ এর নামে একটি ধর্মীয় উৎসবের সময় ঘটনাটি ঘটে।


বেলফোর ঘোষণার পিছনে আর কারা ছিলো? যেখানে ব্রিটেন ওই ঘোষণার জন্য আপাতত দৃষ্টিতে সম্পূর্ণভাবে দায়ী ছিলো কিন্তু এখানে একটি বিষয় গুরুত্বসহকারে উল্লেখযোগ্য যে, ১ম বিশ্ব যুদ্ধকালীন ব্রিটেনের মিত্র শক্তিগুলোর পূর্বমত ছাড়া ব্রিটেনের ওই ঘোষণা দেওয়া সম্ভব ছিলো না। ১৯১৭ সালে যুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভার মিটিংয়ে , ব্রিটিশ মন্ত্রীরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, "কোনো ঘোষণা প্রদানের পূর্বে প্রেসিডেন্ট উইলসনের মতমত গৃহীত হওয়া উচিত"। মন্ত্রীসভার সদস্যেরা স্মরণ করিয়ে দেয় যে আর্থার বেলফোর নিশ্চিত করেছে উইলসন ওই ঘোষণার অনুগ্রাহী।ফ্রান্সও ওই ঘোষণার পিছনে জড়িত ছিলো এবং বেলফোর ঘোষণার সাথে নিজেদের সমর্থন প্রকাশ করেছিল।


১৯১৭ সালে এক ফরাসি কূটনীতিক জুলেস ক্যামবনের, নাহুম সুকুলো নামের এক পোলিশ জায়ানিস্টকে পাঠানো চিঠিতে "ফিলিস্তিনে ইহুদী উপনিবেশ " উল্লেখ করে ফরাসি সরকারের সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত বলে তা প্রকাশ করে এভাবে,

"[I]t would be a deed of justice and of reparation to assist, by the protection of the Allied Powers, in the renaissance of the Jewish nationality in that Land from which the people of Israel were exiled so many centuries ago," stated the letter, which was seen as a precursor to the Balfour Declaration.


বেলফোর ঘোষণা ফিলিস্তিনীদের ওপর কী প্রভাব ফেলেছিল? বেলফোর ঘোষণাকে ১৯৪৮ সালের ফিলিস্তিনী নাকবা সংঘটিত হওয়ার আলামত বলে দেখা হয়ে থাকে যখন ব্রিটিশদের কর্তৃক প্রশিক্ষিত ইহুদী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ৭,৫০,০০০ এর অধিক ফিলিস্তিনীদের নিজ ভিটে থেকে নির্যাতন, নিপীড়ন চালিয়ে জোরপূর্বক বিতাড়িত করে। যুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভার কিছু সদস্য বিরোধিতা করে এরকম পরিস্থিতির আশংকার পূর্বাভাস দিলেও ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণা দেওয়া থেকে বিরত থাকেনি।


এতে কোনো সন্দেহ নেই ব্রিটিশ মেন্ডেট সংখ্যালঘু ইহুদীদের জন্য ফিলিস্তিনীদের তাদের ভূমি থেকে তাড়িয়ে ইহুদীদের জন্য নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল।যখন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা সিদ্ধান্ত নেয় মেন্ডেট ব্যবস্থার ইতি ঘটিয়ে ফিলিস্তিন ইস্যু জাতিসংঘে উথাপন করবে, অন্যদিকে ইহুদীরা ততোদিন নিজেদের আর্মি গড়ে ফেলে। ব্রিটিশদের হয়ে ২য় বিশ্বযুদ্ধ লড়াই করা ইহুদী প্যারা মেলিটারিদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল ওই আর্মি। আরো গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি, ব্রিটিশরা ইহুদীদের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান যেমন ইহুদীদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের জন্য প্রস্তুতি নিতে "ইহুদী এজেন্সি"র মতো প্রতিষ্ঠান গড়ার অনুমতি দিয়েছিল অন্যদিকে ফিলিস্তিনীদের এরকম কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি যা ফিলিস্তিনীদের জাতিগতভাবে নির্মূলের পথ সুগম করে দিয়েছিল।


মূল সুত্রঃ [২০১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার ১০০ শতাব্দী পূর্তিতে আল জাজিরায় প্রকাশিত বিশেষ প্রবন্ধ থেকে অনুদিত। ]